জি ২০ জোটের কাজ কী?

জি ২০ জোটের কাজ কী

জি ২০ জোটের কাজ কী? জি ২০ কিভাবে কাজ করে এবং এই ফোরামের আসল উদ্দেশ্য কি? বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক ফোরাম জি ২০ বা গ্রুপ অফ টুয়েন্টি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অর্থনীতির উনিশটি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে এই ফোরাম গড়ে তুলেছে।

উনিশশো নিরানব্বই সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার পর থেকে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ধারায় জি ২০ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের প্রভাবশালী বেশ কিছু দেশের পারস্পরিক সম্মেলন এবং আলোচনার ফসল হিসেবে জি টোয়েন্টি গঠিত হয়েছে। তবে জি টোয়েন্টি কিভাবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলো তা বোঝার আগে জি সেভেন সম্পর্কে জানতে হবে।

উনিশশো সত্তর সালের দিকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এবং প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ মিলে একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলে। তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখা। সেই সাথে তাদের নিজেদের আর্থিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখা।

পরবর্তীতে সেই জোট কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সাতটি দেশের একটি জোটে পরিণত হয়। সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির এই জোট গ্রুপ অফ সেভেন বা G seven এর নামে পরিচিতি পায়।

এই দেশগুলো মনে করত তারাই মূলত বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা উপলব্ধি করে যে বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আগের চেয়ে অনেক বেশি বদলে যাচ্ছে। এবং শীর্ষ উন্নত দেশগুলোর বাইরেও আরো বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ বৈশিক অর্থনৈতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ছোট বড় সকল দেশই একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তখন জি সেভেনভুক্ত দেশগুলো মনে করলো বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের জোটে প্রতিটি মহাদেশের প্রভাবশালী আরো বেশ কয়েকটি দেশকে যুক্ত করা দরকার।

উনিশশো নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে এশিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়। সেই মন্দার ধাক্কা উন্নত দেশগুলোতেও পৌঁছে যায়।

আরো পড়ুন:

একই সময় তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলো ইউরোপ আমেরিকায় তেল রপ্তানি করা বন্ধ করে দেয়। সব মিলিয়ে তৈরি হওয়া আর্থিক অস্থিতিশীলতা কিভাবে কমানো যায় তা আলোচনার জন্য উনিশটি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানরা জার্মানির বার্লিনে মিলিত হয়।

সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একক ইউনিট হিসেবে যোগ দেয়। উনিশশো নিরানব্বই সালে মিলিত হওয়া সেই উনিশটি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে জি টোয়েন্টি জোটের এর যাত্রা শুরু হয়।

জি টোয়েন্টির এই উনিশটি দেশ হলো আর্জেন্টিনা অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, ম্যাক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

জি টোয়েন্টি কোনো প্রচলিত আন্তর্জাতিক সংগঠনের মতো কাজ করে না। এটি মূলত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম। সে কারণে জি টোয়েন্টির কোন স্থায়ী সচিবালয় বা সদর দপ্তরও নেই।

জি টোয়েন্টির প্রেসিডেন্ট এই ফোরামের কার্যক্রম পরিচালনা করে। সদস্য দেশগুলোর মধ্য থেকে একটি দেশকে পালাক্রমে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট দেশই জি টোয়েন্টি সম্মেলন আয়োজন করা সহ বছর ব্যাপী চলমান সকল কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন।

এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ পর্যায়ক্রমে তাদের এজেন্ডা সেট করার সুযোগ পায়। গত বছর জি ২০ র প্রেসিডেন্ট ছিল ইন্দোনেশিয়া। এবছর প্রেসিডেন্সি পালন করছে ভারত এবং আগামী বছর এই দায়িত্ব পাবে ব্রাজিল। প্রতিটি জি ২০ সদস্য দেশ তাদের পক্ষ থেকে একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে।

এই প্রতিনিধিদেরকে বলা হয় শেরপা। এই শেরপারা তাদের নিজেদের দেশের সুবিধা, অসুবিধা তুলে ধরা সহ জি ২০ এজেন্ডা তৈরী করার কাজ করে থাকে। জি ২০ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হলো finance track নামের একটি প্রক্রিয়া।

জি টোয়েন্টি ফিন্যান্স ট্র্যাক নির্ধারণের জন্য সদস্য দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নরেরা সারা বছর ব্যাপী বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নেন। জি ২০ তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেশ কিছু এনগেজমেন্ট গ্রুপের উপর জোর দেয়।

গ্রুপ গুলো বি টোয়েন্টি, সি টোয়েন্টি, এল টোয়েন্টি, টি টোয়েন্টি এবং ডাবলু টোয়েন্টি নামে পরিচিত। বি টোয়েন্টি বা বিজনেস টোয়েন্টি গ্রুপের প্রধান কাজ হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা।

সি বা সিভিল টোয়েন্টি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। এল টোয়েন্টি বা লেবার টোয়েন্টি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, শ্রমিক অধিকার এবং কর্মসংস্থান বিষয়ক ইস্যু নিয়ে কাজ করে।

টি টোয়েন্টি বা থিঙ্ক টেয়েন্টি সদস্য দেশগুলোর think tank এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে জি ২০ এর সামগ্রিক নীতি নির্ধারণী বিষয়গুলোর ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করে। W twenty বা women twenty লঙ্গিক সমতা এবং নারী ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে।

এই গ্রুপ গুলো থেকে আসা তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে জি ২০ তাদের বৈশ্বিক এজেন্ডা তৈরী করে।

জি ২০ এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করা। এর মধ্যে রয়েছে মুদ্রা বিনিময় হার আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো সমস্যা গুলি সমাধান করা। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশগুলোর মধ্যে নীতি সমন্বয় করে আর্থিক সংকট প্রতিরোধ এবং একটি স্থিতিশীল বয়সিক অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা জি ২০ র প্রধান লক্ষ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টেকসই উন্নয়ন জি টোয়েন্টির গুরুত্বপূর্ণ ফোকাস হয়ে উঠেছে।

সদস্য দেশগুলোর পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং সামাজিক ন্যায্যতার সাথে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, বৈষম্য হ্রাস এবং জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। জি টোয়েন্টি বর্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতি গঠনেও ভূমিকা পালন করে।

সদস্য দেশগুলি বাণিজ্য বাধা, শুল্ক এবং বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে। এর মাধ্যমে সকলের জন্য উন্মুক্ত বাণিজ্যিক পরিবেশ এবং ন্যায্য বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা হয়।

এর বাইরে আন্তদেশীয় বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নও জি টোয়েন্টির এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে। জি ২০ তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা IMF এর মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করে।

এর কারণ হলো এই দুটি প্রতিষ্ঠান যেন বিশ্বব্যাপী তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ গুলো আরো সহজে মোকাবিলা করতে পারে।

জি ২০ র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন গুলোর মধ্যে একটি হলো দুই হাজার আট সালের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করা। জি টোয়েন্টি নেতারা স্থিতিশীল করার জন্য আর্থিক উদ্দীপনা প্যাকেজ আর্থিক খাতের সংস্কার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছে। যার ফলে সেই বৈশিক আর্থিক মন্দাকে খুব কম সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছিল।

ভবিষ্যতে যেন আবারও একই ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি না হয় সেজন্য ব্যাঙ্কগুলোকে আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাজেল থ্রি ফেমওয়ার্ড এবং ফিনান্সিয়াল স্ট্রাবিলিটি বোর্ড বা এফএসবি গঠন করা হয়।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বাইরে টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপরও জি ২০ বেশ জোর দিচ্ছে। দুই হাজার পনেরো সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জি ২০ সদস্য দেশগুলো একসাথে কাজ করে যাচ্ছে।

জি টোয়েন্টি জোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করলেও এর সদস্য দেশগুলোর ভেতরেই বাণিজ্যিক উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিপরীত মেরুতে থাকা দুটি দেশ এই জোটে থাকার কারণে আদৌ কোনো বাণিজ্যিক সহাবস্থান তৈরী করতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

জি ২০ আরেকটি সমালোচনা হলো এটি অনেক ছোট দেশকে তাদের আলোচনার টেবিল থেকে দূরে রাখে। কিন্তু বিপরীত ভাবে তাদের সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলো ছোট ছোট অর্থনীতিতে অনেক বড় প্রভাব তৈরি করে। কিছু কিছু সমালোচক জি ২০ এর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। জি ২০ বিভিন্ন চুক্তি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। এবং এর সদস্য দেশগুলো সবসময় তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলে না।

ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে জি ২০ অনেক দিক থেকেই তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে স্থিতিশীল সমৃদ্ধ এবং টেকসই বিশ অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা বলা হলেও জি ২০ এ ব্যাপারে খুব কম সফলতাই অর্জন করতে পেরেছে।

Top Stories BD এর সর্বশেষ ব্রেকিং নিউজ পেতে Google News অনুসরণ করুন